- 19 October, 2023
- 0 Comment(s)
- 1683 view(s)
- লিখেছেন : সিউ প্রতিবেদক
‘আব্বু মারা যাওয়ার সময় সবে কলেজে ঢুকেছি। আইনের ছাত্রী তখন। আব্বুর তৈরি করা সম্পত্তি ভাগ হচ্ছে। আমার মা, দাদি আর আমরা দু’বোন সম্পত্তির অংশীদার ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, যে ফুপুদের সঙ্গে আব্বুর সম্পর্ক খারাপ ছিল, তাঁরাও এলেন আব্বুর সম্পত্তির ভাগ নিতে। কারণ আমার আব্বু-মায়ের কোন ছেলে নেই। আমরা যে মেয়ে, তাই আব্বুর সম্পত্তিতে তাঁদেরও হক রয়েছে। অথচ আমাদের দাদা বা ভাই থাকলে এই আত্মীয়রা ভাগ পেতেন না। তখন থেকেই অপমানের জ্বালা বইয়ে বেড়াচ্ছি। ভারতীয় আইন নিয়ে এখন গবেষণা করতে গিয়ে সেই অপমান আরও তীব্র হচ্ছে আমার মধ্যে।’-বললেন গবেষক কবিতা হক (নাম পরিবর্তিত)।
মুসলিম পৈতৃক সম্পত্তি বণ্টনের লিঙ্গবৈষম্যে ক্ষুব্ধ কবিতা চাইছেন এই আইনের সংস্কার। তিনি এখনও আতঙ্কিত মায়ের সম্পত্তি নিয়ে। মায়ের অবর্তমানে একই দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হবে তাঁদের। মামারা এসে ভাগ নেবেন। সেই আশঙ্কা থেকে মা চাইছেন সম্পত্তি তাঁদের নামে লিখে দিতে। কিন্তু কেন এই লুকোচুরি? নিজের সম্পদের জোরে মাথা উঁচু করে মা বেঁচে থাকবেন। মায়ের অবর্তমানে সম্পত্তি তাঁর মেয়েদের হবে। ছেলে নেই বলে আত্মীয়রা সম্পত্তির ভাগ নেবে কেন? এটা কি জরিমানা? কবিতার বক্তব্য, ‘যে বাড়িটার সঙ্গে যুক্ত আছে আমাদের আবেগ, আমাদের বেড়ে ওঠার স্মৃতি, আব্বু-মায়ের কষ্টে অর্জিত অর্থের যোগান, সেই বাড়িটারও শরিক হবেন বাইরের লোক? যাঁদের কাছে বাড়িটা শুধু ইট, কাঠ, পাথর। ছেলে এবং মেয়ে একইভাবে বাবা-মায়ের সন্তান। একইভাবে দায়িত্বশীল। তবে সম্পত্তি বণ্টনে এত বঞ্চনা কেন? সম্পত্তিতে অন্যের দখলদারির চিন্তায় আমার মা আজ যে মানসিক কষ্টে ভুগছেন তার খেসারৎ কে দেবে? আত্মীয়রা যত সামান্যই পান না কেন, সেটা তো মেয়ে বলেই পাচ্ছেন। ছেলে হলে মকুব। এমনটা তো আর মানা যাবে না। একই দেশে যখন দেখছি আমার হিন্দু বান্ধবীরা সম্পত্তির সমান অধিকার পেল, তাহলে আমরা পাব না কেন?’
মুসলিম পৈতৃক সম্পত্তি বণ্টনে লিঙ্গবৈষম্য প্রকট থাকায় বহু মুসলিম নাগরিক ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন। কারণ মুসলিম পরিবারগুলোর জীবনধারা বদলেছে। ছেলে-মেয়ে একইভাবে লেখাপড়া শিখছেন। কর্মক্ষেত্রেও মুসলিম মেয়ের যোগ দেওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। সাংস্কৃতিক জগতেও যুক্ত হচ্ছেন। নারী-পুরুষভেদে অনেক মুসলিম তাই লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধেও মুখ খুলছেন। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক তো সম্পত্তির এই অসম বণ্টন। তাকে জিইয়ে রেখে তো লিঙ্গসাম্য আনা যায় না।
তবে জিইয়ে রাখার জন্য এই আইনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকও দুর্লভ নয়। কিছু মানুষ যেটা বলেন- সব আত্মীয়রা দাবি করেন না। সম্পত্তির ভাগ ছেড়ে দেন। দরিদ্র আত্মীয়দের একটু ভাগ দিতে এত কেন কার্পণ্য? এরকম অনেক যুক্তি ছুটে আসে। তবে আত্মীয়রা ভাগ ছেড়ে দেন, এই কথার মধ্যেও চরম অপমান রয়েছে। নিজের সম্পত্তি অন্যের হাত থেকে দান হিসেবে নিতে হবে কেন? মেয়ে বলে? ছেলে হলে আত্মীয়রা সম্পত্তিতে নাক গলাতে পারবেন না। আর দরিদ্র আত্মীয়দের হকের কথা মেয়ের সম্পত্তি ভাগের সময় মনে পড়ে? ছেলের সম্পত্তিতে হক থাকে না কেন? তাছাড়া দরিদ্র বলেই আত্মীয়দের হক বসে এমনটাও নয়। মুসলিম সম্পত্তি আইনে শুধু মেয়ে সন্তান থাকলে নিকট আত্মীয়রা শরিক হন, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে। অধিকার সচেতন মনকে জোরালো ধাক্কা দিচ্ছে এই বঞ্চনার আইন। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাবার সময় এসেছে। নানান যুক্তিজালে সমস্যাকে আড়ালে রাখবেন না বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেবেন?
ছবি : প্রতীকী
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২৬ জুন, ২০২০
0 Comments
Post Comment